ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট ও ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি
ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট ও ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি
নিশি আর এখন যেখানে সেখানে
লাইক দেয় না, যার তার পোস্ট শেয়ার করে না। তার এই পরিবর্তনের কারণ কী?
স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরছে নিশি, সামি, সায়মা, মাইশা। পথ চলতে চলতে তারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছে।
সামি: আজ তোদের একটা মজার
বিষয় বলবো।
সায়মা: বল, কী বলবি।
মাইশা: তোর মজার বিষয়গুলোতো
সবই ইন্টারনেট নিয়ে। এবার কী হলো?
সামি: আমি অনলাইনে লেটেস্ট
মোবাইল ফোন সার্চ করেছিলাম। তারপর থেকে আমার মেইল আর ফেসবুকে শুধু স্মার্ট ফোনের
বিজ্ঞাপন আসছে।
নিশি: আরে এটা হলো তোর আচরণের একটা ফল যাকে ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট বলে। আমার বড় ভাই শাহীন আমাকে এ সম্পর্কে বলেছে।
সামি: আমাদের একটু বুঝিয়ে বল, বিষয়টা কী?
নিশি: ভাইয়া বলেছে, ইন্টারনেটে কোনো কিছুই গোপন
থাকে না। আমরা যা কিছু করি তার চিহ্ন থেকে যায়। আমরা
কোন কোন ওয়েবসাইট ব্রাউজ করি, গান-সিনেমা-অডিও-ভিডিও দেখি, তথ্য সার্চ
করি…কতক্ষণ দেখি, কী পড়ছি, কোথায় লাইক-শেয়ার দিয়েছি, কী আপলোড বা ডাউনলোড করি,
এই সব তথ্য আমাদের অজান্তেই কোথাও না কোথাও থাকে।
সামি: বলিস কী? এসব তথ্য কোথায় থাকে? কারা সংগ্রহ করে এসব তথ্য? বিস্তারিত বল নিশি।
নিশি: একজন ব্যক্তির
পছন্দ-অপছন্দ, বিশ্বাস, অভ্যাস, কেনাকাটাসহ
সব তথ্য ব্রাউজার, সার্চ ইঞ্জিন, অ্যাপ
আর ওয়েবসাইটে সংরক্ষিত থাকে। ব্যবহারকারির সুবিধার জন্য
ওয়েবসাইটে তথ্যগুলো সংরক্ষিত থাকে। ওয়েবসাইট এরপর আমাদের পছন্দমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে
থাকে। যেমনটা সামি পেয়েছে। কখনো আমরা জেনে বুঝে এই সব তথ্য দেই আবার কখনো না জেনে বুঝে তথ্য দেই।
মাইশা: তাই নাকি, একটু খুলে বলতো!
নিশি: ইচ্ছাকৃতভাবে যে সব
আচরণগত তথ্য সরবরাহ করা হয় সেটা হলো সক্রিয় ফুটপ্রিন্ট আর অনিচ্ছাকৃতভাবে যখন তথ্য
চলে যায় সেটা হলো নিস্ক্রিয় ফুটপ্রিন্ট। আমরা যখন ইমেইল, ওয়েবসাইটে লগ ইন করার জন্য বা
সামাজিক মাধ্যমগুলোতে কোন পোস্ট দেই, লাইক-শেয়ার-কমেন্ট করি
বা ছবি-অডিও-ভিডিও আপলোড বা ডাউনলোড করি বা কোনো অ্যাপ বা সফটওয়্যার ইন্সটল করার
সময় আমরা যেসব তথ্য দেই। এক কথায়, অনলাইনে আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে
যে সব তথ্য দেই সেটাই সক্রিয় ফুটপ্রিন্ট।
নিশি: অন্যদিকে নিস্ক্রিয়
ফুটপ্রিন্ট হলো যখন আমরা নিজের অজান্তেই অনলাইনে তথ্য রেখে আসি। যেমন - তথ্য সার্চ
করা, বিভিন্ন
সাইট ব্রাউজ করা, কুকিজ সক্রিয় করা, ক্ষতিকর
অ্যাপ ইন্সটল করা, ফিশিং সাইটে ব্রাউজ করা প্রভৃতি। ইচ্ছাকৃত
বা অনিচ্ছাকৃতভাবে আমাদের এই রেখে যাওয়া তথ্যই হলো ফুটপ্রিন্ট। এই ফুটপ্রিন্ট ধরেই
আমাদের অনুসরণ করা সম্ভব। আমরা যখন ব্লগে কমেন্ট করি, কোনো পেইজে লাইক দেই, এসব দেখে আমাদের মানসিকতার ধরন বোঝা যায়।
মাইশা: এসব রেকর্ড কোন কোন
কাজে লাগে?
নিশি: চাকরি, বীমাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসব
তথ্য ব্যবহার করা হয়। এমনকি দূতাবাসগুলোতে এসব তথ্য যাচাই করে। তবে সবচেয়ে খারাপ
বিষয় হলো আমাদের প্রাইভেসি একেবারেই থাকে না। এসব তথ্য ব্যবহার করে ব্যক্তিগত বা
দলগত স্বার্থে ক্ষতিকর কাজে ব্যবহার করা যায়। যেমন কারো মনোভাব বা রাজনৈতিক
বিশ্বাস জানতে পারলে তাকে সহজে প্রভাবিত করা যায়।
আমাদের তথ্য কোনো
সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের হাতে যেতে পারে। এতে আমরা বিপদে পড়তে পারি। তারা বিভিন্ন
ফাঁদে ফেলে আমাদের সন্ত্রাসবাদী কাজে যুক্ত করতে পারে। অনেক উগ্রপন্থী গ্রুপ আছে
যারা আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে তাদের দলে নেয়া ও উগ্রবাদী
কাজে যুক্ত করার চেষ্টা করতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কোন উগ্রপন্থী গ্রুপের পেইজ বা
ওয়েবসাইটে লাইক-শেয়ার-কমেন্ট করলে সেখানে ফুটপ্রিন্ট থাকে। সেই ফুটপ্রিন্ট দেখে
তারা পরবর্তীতে তাদের দলে নেবার চেষ্টা করতে পারে। এরপর যারা একটু প্রভাবিত হয়
তাদের সরাসরি সংগঠনে যুক্ত করা হয়। এরপর তাদের সহিংস উগ্রবাদী
হিসেবে গড়ে তোলা হতে পারে।
ধর্ম আক্রান্ত হওয়া বা
ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে অথবা ধর্মীয় নিয়ম-কানুন মেনে চলার কথা বলে
প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে পারে। উগ্রপন্থী গোষ্ঠী তাদের মতাদর্শ বা রাজনীতি
প্রচারের মাধ্যমে তরুণদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে পারে। সবশেষে
তাদের উগ্রবাদী-সন্ত্রাসবাদী কাজে জড়িয়ে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
সায়মা: এটাতো আমার জানা ছিলো
না, আমরা এসব
থেকে সাবধান থাকবো কীভাবে?
নিশি: ইন্টারনেটে আমাদের
বিচরণ সুচিন্তিত ও পরিবর্তনশীল হতে হবে। যাতে এর মাধ্যমে আমরা আমাদের দুর্বলতা
প্রকাশ করে না ফেলি।
সায়মা: বুঝেছি, আর কী করা যেতে পারে?
নিশি: অপ্রয়োজনীয়
তথ্য না দেওয়া, অপ্রয়োজনে লোকেশন অন না করা, ইমেইল, ফোন নম্বর, ঠিকানা কোথাও না দেওয়া।
সামি: তাহলে ফুটপ্রিন্ট হলো
আচরণগত চিহ্ন?
নিশি: হ্যাঁ, এই কারণে বাস্তব জীবনে আমরা
যেমন সবার সাথে বন্ধুত্ব করি না, সবার বাসায় যাই না, সব মানুষের সাথে মেলামেশা করি না, তেমনি ডিজিটাল
জগতেও এসব মেনে চলতে হবে। ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট দিয়ে অনলাইনে একজন ব্যক্তির সামগ্রিক
পরিচয় গড়ে ওঠে। অনলাইনে এই পরিচয় দিয়েই সেই ব্যক্তিকে মূল্যায়িত হয়। আমরা
চেষ্টা করবো অনলাইনে নিজের সম্পর্কে ভালো ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে। সামাজিক মাধ্যমে জেনে
বুঝে লাইক-শেয়ার দেবো। আমি ভালো মনে করি না, এমন ওয়েবসাইট ব্রাউজ করবো না।
সামি: এতো কিছুতো মনে থাকবে
না।
নিশি: একটা কথা মনে রাখবে।
ইন্টারনেটে যা ইচ্ছা তা করা যাবে না। জেনে বুঝে ইন্টারনেটে বিচরণ করতে হবে।
আরো
জানতে চাও?
১। আইডেন্টিটি থেফট বা পরিচয়
চুরি বলতে কী বোঝায়?
সাইবার অপরাধীরা কোন
ব্যক্তির অজান্তে পাসওয়ার্ড, ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার, ক্রেডিট কার্ড
নাম্বার থেকে শুরু করে সব ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করতে পারে। একেই বলে পরিচয়
চুরি করা।
২। ডিজিটাল ফুটপ্রিন্টকে
নিরাপদ রাখা যায় কীভাবে?
- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিরাপত্তা সেটিংস
ব্যবহার করা।
- অপরিচিত কারো পোস্টে লাইক-শেয়ার-কমেন্ট না করা, নিজের পোস্ট পাবলিক না করা।
- এন্টি-ভাইরাস ব্যবহার করা।
- নিষিদ্ধ ও অনিরাপদ ওয়েবসাইটে না যাওয়া।
- ফোন নম্বর, ইমেইলসহ ব্যক্তিগত তথ্যগুলো অনিরাপদ কোথাও
না দেয়া।
- টু-স্টেপ ভ্যারিফিকেশন চালু করা।
সমুদ্র সৈকতে হেঁটে গেলে যেমন পায়ের চিহ্ন থেকে যায়; তেমনি সাইবারের সকল কাজের চিহ্ন থেকে যায় আমাদের অজান্তেই। এই ডিজিটাল ফুটপ্রিন্টই গড়ে ...