শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ ও ঝুঁকি মোকাবেলা
শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ ও ঝুঁকি মোকাবেলা
নিশির খালা শামীম আর সিয়ামকে বুঝিয়ে বলছেন শিশুর সুস্থ-স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের জন্য কেমন পরিবেশ অত্যাবশ্যক। কারণ যাতে তারা অন্যদের সহযোগিতা করতে পারে ও ফিরিয়ে আনতে পারে অন্ধকার পথ থেকে।
নিশি: খালা তোমার হাতের রান্নার
কোনো তুলনা নেই। চাওমিন
আর চিকেন ফ্রাই আমি অনেক
পছন্দ করি।
শামীম: স্যুপ আর ফ্রাইড রাইসও
অনেক ভালো হয়েছে।
সিয়াম: ডেজার্টে পুডিং খেতে আমার খুব ভালো
লাগে।
খালা: তোমাদের ভালো লেগেছে শুনে
আমারও খুব ভালো লাগছে।
নিশি: খাওয়ার আগে তুমি বলেছিলে, বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী আচরণগত সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় সম্পর্কে জানাবে।
খালা: হ্যাঁ এবার আমি তোমাদের সেটাই
বলবো। শামীম ও সিয়াম তোমরা অবশ্যই মন দিয়ে
শুনবে।
খালা: তোমাদের আগেই বলেছি, সাধারণত যেসব শিশুরা তীব্র মানসিক চাপে বড় হয় তারা অপরাধমূলক বা অসামাজিক কাজ
কর্ম, নেশা করা কিংবা উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়তে পারে।
নিশি: তোমার কথার অর্থ হলো, একজন কিশোরের আচার আচরণ দেখে আমরা ধারণা করতে পারি বড় হয়ে সে কী করবে।
খালা: তুমি ঠিকই বলেছো। যদি বাবা-মা, পরিবারের সদস্য বা শিক্ষক কিংবা সমাজের সদস্যরা যদি শিশু কিশোরদের বহির্মুখী
ও অন্তর্মুখী আচরণের লক্ষণগুলো জানেন, তাহলে খুব সহজেই তারা ঐ
শিশু-কিশোরের জীবন পরিবর্তন করে দিতে পারেন।
খালা: এই লক্ষণগুলো জানলে তারাও বুঝতে
পারবেন শিশু কিশোরদের সাথে তাদের কী ধরনের আচরণ করা উচিত।
সিয়াম: লক্ষণগুলো আপনি আমাদের আগেই বলেছেন। এবার বলুন কোনো শিশু-কিশোরের মধ্যে এই সব লক্ষণ
দেখা গেলে আমাদের করণীয় কী?
খালা: পরিবার থেকেই আমাদের কাজ শুরু
করতে হবে। শিশুর জন্য ঘরকে নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত
করতে হবে। ঘরকে আনন্দময় করে গড়ে তুলতে হবে।
খালা: শিশুর জন্য ঘরে শাসন, শাস্তি, ভয় আর আতঙ্কের পরিবেশ থাকবে না। বাবা মায়ের কলহ, অতিরিক্ত শাসন,
পড়ার চাপ শিশুর মনে ভয়, আতঙ্ক, নিরাপত্তার অভাব তৈরি করে। তার মনে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে।
সিয়াম: আপনার কথা শুনে আমার খুব মন খারাপ
হচ্ছে; কারণ আমাদের অনেক পরিবারেই শিশুর বসবাসের জন্য উপযুক্ত
পরিবেশ নেই।
খালা: আমরা সচেতন হলেই শিশুর বসবাসের
জন্য উপযুক্ত ঘর কিংবা পৃথিবী নির্মাণ করতে পারি। সুখী-সমৃদ্ধ দেশ ও সমাজ গড়তে হলে শিশুর
জন্য ইতিবাচক পরিবেশ গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই।
খালা: শিশুরা একটু দুষ্টুমি করতেই পারে,
এটাই শিশুর জন্য স্বাভাবিক আচরণ। কিন্তু এর জন্য শিশুকে কোনভাবেই শারীরিক শাস্তি দেয়া উচিত নয়। এতে শিশুর ক্ষতি হয়।
খালা: পরিবারের পরেই একটি শিশু সবচেয়ে
বেশি সময় কাটায় স্কুলে, কাজেই স্কুলের পরিবেশও তার জন্য নিরাপদ
ও ভয় মুক্ত হতে হবে। স্কুলে যেনো অতিরিক্ত শাসন, শাস্তি, ভয় আর আতঙ্কের পরিবেশ না থাকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
খালা: শিশু যেন স্কুলে যেতে ভয় না পায়,
কোন শিক্ষককে ভয় না পায়, স্কুলে সেই পরিবেশ নিশ্চিত
করতে হবে। ঘরের মতোই স্কুল যেনো শিশুর জন্য নিরাপদ
আশ্রয় হয়। ঘরের মতোই স্কুলকে আনন্দময় করে গড়ে
তুলতে হবে।
নিশি: অনেক স্কুলেই এমন পরিবেশ নেই খালা। অনেকেই পড়ার চাপ কিংবা শাস্তির ভয়ে স্কুলে যেতে
চাই না। স্কুলের কথা মনে হলেই ভয় আর আতঙ্ক
লাগে।
খালা: এই অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়েছে। সরকার শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করেছে। এ বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছে।
শামীম: খালা, যাদের
অন্তর্মুখী আচরণের সমস্যা আছে তারা কীভাবে এই সমস্যা থেকে মুক্ত হবে?
খালা: খুবই সহজ। বাবা-মা কিংবা শিক্ষক অর্ন্তমুখী
ছেলে-মেয়েদের নানা ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে যুক্ত করবেন। তাদের সাথে উপহাস, বিদ্রূপ, অপমানজনক কথা বলবেন না।
খালা: অন্তর্মুখী ছেলে-মেয়েরা সহজে অন্যদের সাথে মিশতে পারে না তাই অন্যদের উদ্যোগী হয়ে তাদের সাথে
মিশতে হবে। এ বিষয়ে শিক্ষক নিজে উদ্যোগী হয়ে তাদের
সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করবেন।
খালা: স্কুলের নানা ধরনের কর্মকাণ্ডে
অথবা দলগত কাজে তাদের যুক্ত করতে হবে। নাচ, গান, আবৃতি, বক্তৃতা, বিতর্ক, খেলাধুলার মতো
সংস্কৃতিক কাজ কর্মে তাদের যুক্ত করতে হবে।
শামীম: এই ধরনের কাজ করলে কি তারা অর্ন্তমুখী
আচরণের সমস্যা থেকে মুক্ত হতে পারবে?
খালা: এই ধরনের কাজে যুক্ত থাকলে তাদের
জড়তা কেটে যাবে। তারা ধীরে
ধীরে অর্ন্তমুখী আচরণ কাটিয়ে উঠতে পারবে।
খালা: বাবা-মা,
শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধবসহ অন্যদের
সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে কারণ অন্তর্মুখী আচরণ নিজে নিজে কাটানো বেশ কঠিন।
শামীম: এবার আমি বুঝতে পেরেছি কীভাবে
নিজে সমস্যা থেকে মুক্ত থাকবো, আর অন্যদের সমস্যা থেকে মুক্ত
করতে পারবো।
সিয়াম: খালা এবার বহির্মুখী আচরণগত সমস্যা
থেকে মুক্তির উপায় সম্পর্কে বলুন।
খালা: এটাও অনেক সহজ। বহির্মুখী আচরণগত সমস্যা যুক্ত শিশুদের দুষ্টু, ডানপিটে, বেয়াদব বলে অবজ্ঞা বা দোষারোপ করা যাবে না।
খালা: এই ধরনের শিশুদের বঞ্চনা,
অবহেলা, বকাঝকা, শারীরিক
শাস্তি দেয়া হয় এতে তারা মানসিকভাবে আরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের আরো ক্ষতি হয়। তাই এই সব কাজ একেবারেই করা যাবে না।
খালা: উগ্র-অবাধ্য-আগ্রাসী-অতিচঞ্চল আচরণ নিয়ে তাদের সাথে কথা বলতে হবে। অন্যরা তার আচরণে কষ্ট পায় সেটা বুঝিয়ে বলতে হবে। উপযুক্ত আচরণ কোনটা সেটা বুঝিয়ে বলতে হবে।
নিশি: স্কুলে অনেক ছেলে মেয়ে আছে যাদের
এই সমস্যাগুলো আছে। এবার বুঝতে পারছি আমরা তাদের কীভাবে সাহায্য করবো।
খালা: শুধু তোমার একা বুঝলেই হবে না
অন্যদেরও বোঝাতে হবে। তবে এই দুই সমস্যার বাইরেও আরো অনেক বিষয় আছে যেগুলো কিশোরদের উগ্রবাদ থেকে মুক্ত
রাখতে পারে।
খালা: পরিবার এবং স্কুল থেকে শিশুদের
ধর্মীয় সহনশীলতা ও সম্প্রীতির গুরুত্ব নিয়ে বোঝাতে হবে। ধর্মীয় উগ্রবাদের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে সচেতন
করে গড়ে তুলতে হবে।
খালা: সমাজে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, দর্শন,
বিশ্বাস, প্রথা, রীতিনীতি, ভিন্নমত, সংস্কৃতির
সাথে শিশুদের পরিচয় করিয়ে দিতে হবে; এই বিষয়গুলোকে শ্রদ্ধা ও
সম্মান করা শেখাতে হবে।
খালা: অবাধ্য কিংবা মিশুক নয় বলে শিশুদের
দূরে ঠেলে না দিয়ে সকল কাজে তাদের সক্রিয়ভাবে যুক্ত করতে হবে।
নিশি: তোমাকে অনেক ধন্যবাদ খালা। আজ আমরা তোমার কাছ থেকে
অনেক কিছু জানতে পারলাম।
শামীম: আজ আপনার কাছে না আসলে
আমরা অনেক কিছুই জানতে
পারতাম না।
সিয়াম: আপনার কথায় আমিও অনেক
উপকৃত হয়েছি। আপনাকে
ধন্যবাদ খালা।
খালা: তোমাদেরও অনেক ধন্যবাদ।
মানসিক বিকাশ একজন মানুষকে সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের জন্য প্রস্তুত করে তোলে। তাই শিশুকাল থেকেই প্রয়োজন শিশুর জন্য সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ ...