সহিংস উগ্রবাদের সংকট মোকাবেলা
সহিংস উগ্রবাদের সংকট মোকাবেলা
শামীম সমাজের জন্য ভালো কিছু করতে চায়। কিন্তু তা করতে গিয়ে সে নিজেই জড়িয়ে পড়ে বিপদে। তাই তার বন্ধুরা এগিয়ে আসে তাকে সাহায্য করতে।
শামীম নবম শ্রেণিতে পড়ে, কিছুদিন ধরেই সে অন্যমনস্ক।
লেখাপড়ায় মনোযোগ নেই, খেলাধুলায় অংশ নেয় না। বন্ধুদের সাথেও আগের মতো মেলামেশা করে না। শামীমের এই বিশেষ পরিবর্তনের কারণ বোঝে তার
বন্ধু নিশি ও সামি। তারা একদিন শামীমের সাথে কথা বলে।
সামি: কেমন আছিস শামীম?
বেশ কিছুদিন ধরে তোকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে?
নিশি: সবাই মাঠে খেলছে, আর তুই একা বসে আছিস কেন?
শামীম: আমার কিছুই ভালো লাগে না। সবসময় খুব অস্থির আর একা লাগে।
সামি: তোর কী হয়েছে আমাদের খুলে বল।
নিশি: কাছের বন্ধুদের সবকিছু খুলে বলতে হয়। আমরা তোকে সাহায্য
করতে পারি।
শামীম: না থাক। আমার কথা শুনে তোরা হাসবি।
সামি: আরে বোকা, আমরা হাসবো কেন? আমাদেরকে বলেই দেখ।
শামীম: সারা দুনিয়ায় ধর্ম আজ আক্রান্ত-বিপন্ন। ধার্মীকদের দুঃখ
দুর্দশার শেষ নেই। সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, আফগানিস্তানসহ দেশে দেশে আমাদের
ধর্মপ্রাণ মানুষেরা মার খাচ্ছে। নারী শিশুসহ অনেক নিরীহ মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা
নির্যাতন করা হচ্ছে। সারা দুনিয়ায় আমাদের ধর্ম আক্রান্ত। ধর্মকে রক্ষা করতে হবে।
জালিমদের হাত থেকে ধার্মীকদের বাঁচাতে হবে।
সামি: কিন্তু এসবের সাথে তোর বিষণ্ণতা আর মন খারাপের
সম্পর্ক কী?
শামীম: একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ হিসেবে এসব অন্যায় অবিচার
আমাকে আহত করে, কষ্ট দেয়, মন খারাপ হয়।
সামি: কীভাবে তুই ধর্মকে কীভাবে রক্ষা করবি? কীভাবে
ধার্মীকদের রক্ষা করবি?
শামীম: একমাত্র উপায় হলো ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে
হবে। ধর্মের পথে যুদ্ধ করতে হবে। আমি ধর্মযুদ্ধ করার কথা ভাবছি।
নিশি: আমরা আগেই এমনটা আশঙ্কা করেছিলাম। আমাদের কথা শোন
আমরা তোকে সাহায্য করতে পারবো।
সামি: ধর্ম নিয়ে তোর দুঃশ্চিন্তা ঠিকই আছে। কিন্তু সমস্যা
সমাধানের পথ হিসেবে তুই যে চিন্তা করেছিস, সেটা ভুল পথ। আমাদের আশঙ্কা তুই একটা ষড়যন্ত্রে
পা দিয়েছিস। আমার বড় ভাই শাহিন আমাকে এ বিষয়ে সম্পর্কে বলেছে।
শামীম: কিসের ষড়যন্ত্র? আমাকে একটু বিস্তারিত বল তো।
নিশি: এবার আমি কিছু কথা বলবো, দেখতো তোর সাথে মেলে কিনা?
নিশি: সোশ্যাল মিডিয়া বা অন্য কোনোভাবে তোর নতুন কারো সাথে
পরিচয় হয়েছে। যাকে তোর অনেক মেধাবী, জ্ঞানী আর বুদ্ধিমান বলে মনে হয়েছে।
শামীম: ঠিকই বলেছিন। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আদিল ভাইয়ের
সাথে পরিচয় হয়েছে যিনি অনেক মেধাবী, বুদ্ধিমান। তার অনেক লেখাপড়া। তিনি অনেক কিছু
জানে।
সামি: সেই আদিল ভাই তোকে ধর্মপ্রাণ মানুষদের দুঃখ দুর্দশার
কথা বলেছে। তোকে নিশ্চয় অনেক কিছু পড়ার কথা বলেছেন?
শামীম: হ্যাঁ, আদিল ভাই আমাকে অনেক ওয়েবসাইটের লিংক, আর
পড়ার জন্য বইপত্র দিয়েছে। সিরিয়ার ধর্মপ্রাণ মানুষদের ওপর নির্যাতনের কিছু ভিডিও
দিয়েছে দেখার জন্য।
নিশি: এই নির্যাতন থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে সেই আদিল ভাই তোকে ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা
করার কথা বলেছে।
সামি: তোর সেই আদিল ভাই কি তোকে কোনো সংগঠনে যোগ দেয়ার কথা বলেছেন?
শামীম: হ্যাঁ বলেছে। দেশে একটা সংগঠন আছে যারা ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এবং ধর্মযুদ্ধে
অংশ নেয়ার জন্য সংগ্রাম করে। আমাকে সেই সংগঠনে যুক্ত হতে বলেছে। কিন্তু তোরা এসব কীভাবে
জানলি? এসবতো আদিল ভাই আমাকে গোপন রাখতে বলেছে। এসব অত্যন্ত গোপন বিষয়।
সামি: আমরা জানি দেশে অনেক সহিংস উগ্রবাদী সংগঠন আছে যারা এই উপায়ে কর্মী সংগ্রহ
করে। তুই তাদের ষড়যন্ত্রের জালে ধরা পড়েছিস।
নিশি: এরা ধর্মপ্রাণ কিশোরদের ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে। ধার্মীকদের ওপর
অত্যাচার নির্যাতনের নানা ধরনের ফেক ভিডিও, ছবি দেখিয়ে বা উগ্রবাদী বই পত্র পড়িয়ে তাদের
উত্তেজিত করে তোলে।
সামি: তারপর সুযোগ বুঝে তাদের উগ্রবাদী সংগঠনে যুক্ত করে। তরুণদের ঠেলে দেয় সহিংস
উগ্রবাদের অন্ধকার পথে।
নিশি: সেই তরুণেরা আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে না। তারা তাদের পরিবার বা
বাবা-মায়ের কাছ থেকে হারিয়ে যায় অন্ধকার জগতে।
শামীম: তোদের কথা শুনে আমার চোখ খুলে গেছে। এতবড় ভুল আমি কীভাবে
করলাম? এই ষড়যন্ত্র থেকে আমি মুক্ত হবো কী করে?
সামি: চিন্তা করিস না, আমরা জানি কিভাবে এই অন্ধকার পথ থেকে
বের হয়ে আসাতে হয়।
শামীম: কিন্তু নির্যাতিত, নিপীড়িত ধর্মপ্রাণ মানুষদের আমি কীভাবে
রক্ষা করবো? আমি তাদের জন্য কিছু করতে চাই।
নিশি: তাদের জন্য অনেক কিছু করার আছে। পৃথিবীকে সুন্দর ও
বাসযোগ্য করে তোলার জন্য আমরা অনেক কাজ করতে পারি।
সামি: কোনো ধর্মেই উগ্রবাদের স্থান নেই, সোশ্যাল মিডিয়া
ব্যবহার করে আমরা এসব মানুষকে জানাতে পারি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুরুত্ব, ধর্মীয়
বিদ্বেষের প্রভাব, উগ্রবাদ থেকে মানুষের
রক্ষার উপায় সম্পর্কে ক্যাম্পেইন করতে পারি।
নিশি: কীভাবে যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে হয়, সেটা শেখাতে
পারি। যেন মানুষ উগ্রবাদের ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত থাকতে পারে।
সামি: আমরা আমাদের পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতদেরও সচেতন করা, সহিংস উগ্রবাদ সম্পর্কে সচেতন করতে
পারি। যুক্তি দিয়ে চিন্তা করা আর পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করার দক্ষতা থাকলে আমরা
উগ্রবাদের হাত থেকে মুক্ত থাকতে পারবো।
শামীম: কিন্তু পৃথিবীর দেশে দেশে ধার্মীকরা আক্রান্ত হচ্ছে
কেন?
সামি: ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে তারা আক্রান্ত হচ্ছে একথা
সঠিক নয়। এর সাথে আছে ভূ-রাজনীতি, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, মতের পার্থক্য, খনিজ সম্পদ
দখল, আধিপত্য বিস্তারের নানা জটিল রাজনৈতিক সমীকরণ।
নিশি: আমাদের দেশেও যেনো এ ধরনের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি না হয়
সেজন্য আমাদের সচেতন থাকতে হবে। সবাইকে সচেতন করতে হবে।
সামি: আর একটা কথা কখনো একা বোধ করলে, বিষণ্ণ লাগলে আলাদা
হয়ে না গিয়ে প্রিয় মানুষদের সাথে সময় কাটাতে হবে।
নিশি: বাগান করা, বই পড়া বা সিনেমা দেখা বা যে কাজ করতে
ভালো লাগে তাই করতে হবে। তাহলে বিষণ্ণতা থাকবে না।
শামীম: কিন্তু আমার অনেক হতাশ লাগে, অস্থির লাগে। কি করবো
বুঝতে পারি না।
নিশি: বিষণ্ণ, হতাশা বা অস্থিরতা যেমনই লাগুক কখনো নিজেকে
সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে না। প্রিয় বন্ধুদের সাথে সময় কাটাও।
সামি: যা করতে ভালো লাগে ক্ষতিকর না হলে তাই করো।
আত্নবিশ্বাসের অভাব বোধ করলে, যাকে বিশ্বাস করো তার সাথে কথা বলো।
নিশি: এমন পরিস্থিতির কথা চিন্তা কর, যেখানে থেকে তুই দারুণ
চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করে বের হয়ে আসতে পেরেছিস।
শামীম: মাঝে মাঝে মনে হয় আমি যেনো হারিয়ে যাচ্ছি। আমার কোন
পরিচয় নেই, ঠিকানা নেই।
সামি: নিজের আত্মপরিচয় খোঁজা খুবই জরুরি। এতে একজন তরুণ
সমাজে নিজের গুরুত্ব বুঝতে পারে। কিন্তু নিজের কাজ দিয়ে আত্মপরিচয় গড়ে তুলতে হয়।
নিশি: সমস্যা যাই হোক সমাধান আছে। কিন্তু এজন্য আপন কারো
কাছে সব খুলে বলতে হবে। তাদের সাহায্য নিতে হবে। নইলে আদিল ভাইয়ের মতো লোকেরা
বিপদে ফেলবে।
শামীম: তোদের সাথে কথা বলে আমার হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে
আসছে। আমি নিজের মধ্যে একটা শক্তি অনুভব করছি। কিন্তু এখন আদিল ভাইয়ের হাত থেকে
মুক্তি পাবো কিভাবে?
সামি: চিন্তা করিস না। চল আজ সন্ধ্যার পর ক্যাফেতে যাই,
শাহীন ভাই আসবে। আমরা তার সাথে কথা বলবো।
শামীম: কিন্তু এতো বোকামীর কথা তাকে বলবো কীভাবে? তিনি কি
পারবে সাহায্য করতে?
নিশি: তোকে কিছু বলতে হবে না, যা বলার আমরাই বলবো।
সামি: শাহীন ভাই এর আগেও আমাদের নানাভাবে সাহায্য করেছেন।
ভাইয়া নিশ্চয়ই একটা পথ বলতে পারবেন।
জীবনে সমস্যা বা দুশ্চিন্তা আসলে বিষণ্ণ বা অসহায় না হয়ে বন্ধুদের কাছে সাহায্য চাইতে হবে, করতে হবে পছন্দের ...